সায়ীদ আলমগীর ::
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নিত্য ঘটছে হত্যা-সংঘর্ষ। অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধে জড়াচ্ছে একাধিক গ্রুপ। ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি কিংবা কুপিয়ে হত্যার ঘটনাও রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গা বসতিতে নাশকতার আগুন। এই সবকিছুর মূলে এক ব্যক্তিকে দায়ী করছেন সাধারণ রোহিঙ্গা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তিনি হলেন নবী হোসেন (৪৮)।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢলের পর অনুপ্রবেশ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞায় বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে প্রবহমান নাফনদীতে মাছ আহরণ। তবে গোপনে নাফ নদী ও সীমান্তবর্তী চিংড়ি ঘেরে মাছ ধরতে গেলে মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের প্রধান শীর্ষ মাদক কারবারি ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন গ্রুপের টোকেন নিতে হয়। তার ‘টোকেন’ ছাড়া নাফনদ ও সীমান্তবর্তী চিংড়ি ঘেরে মাছ ধরা অসাধ্য। টোকেন ছাড়া মাছ আহরণে যাওয়া কোনো জেলেকে পেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী জেলেদের।
সূত্র মতে, উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্টের মোস্তাক আহমেদের ছেলে নবী হোসেন (৪৭) উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্প এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় সিন্ডিকেট করে অপহরণ-মাদক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন। তার বিরুদ্ধে হত্যা, নারী নির্যাতন, মাদক, অপহরণ ও ডাকাতিসহ থানায় ডজনের অধিক মামলা রয়েছে। এত অভিযোগের পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় নানান অপকর্ম চলমান রেখেছেন নবী হোসেন।
২০১৭ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের পর সরকারি নিষেধাজ্ঞায় নাফনদীতে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। এরপরও কিছু সংখ্যক জেলে ও রোহিঙ্গা পেটের দায়ে কৌশলে নাফনদী ও চিংড়ি ঘেরে মাছ ধরে সংসার চালান। এ সুযোগে মাছ ধরতে ‘টোকেন’ প্রথা চালু করেছে নবী বাহিনী। বার্মিজ ভাষায় লেখা টোকেন নিলেই অনায়াসে নাফনদ ও আশপাশের ঘেরে মাছ ধরতে পারেন জেলেরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে বলেন, নাফনদী ও সীমান্তের পাশে থাকা চিংড়ি ঘেরে মাছ ধরতে হলে প্রত্যেক জেলেকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন গ্রুপকে মাসে ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা দিলে অনায়াসে নাফনদী কিংবা চিংড়ি ঘেরে যেতে পারেন, আর চাঁদা না দেওয়া কাউকে পেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়।
মাসিক চাঁদার বিপরীতে একটি টোকেন সরবরাহ করা হয়। টোকেন থাকলে নাফনদী ও চিংড়ি ঘেরে মাছ ধরতে জেলেদের কোনো বাধা থাকে না।
জেলেদের মতে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমান্তবর্তী তোতারদ্বীপ ও লালচরে নবী গ্রুপের আস্তানা রয়েছে। তাদের দেওয়া টোকেন দলের বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা সদস্যদের মাধ্যমে জেলেদের কাছে পাঠানো হয়। টোকেন ছাড়া মাছ শিকারি পেলে অপহরণ করে আস্তানায় নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালায়। মুক্তিপণ পেলে ছেড়ে দেওয়া হয়। মুক্তিপণ না পেলে অপহৃত জেলেরা হত্যার শিকারও হন।
গত ৯ জুলাই নাফনদী থেকে বাংলাদেশি নাগরিক মানিক (২১), বদি আলম (১৮) এবং রোহিঙ্গা আব্দুর রহমান (২৫) ও রফিককে (১৮) ধরে নিয়ে যায় নবী হোসেন গ্রুপের সদস্যরা। তাদের কাছে মাসিক চাঁদার টোকেন না থাকায় অপহরণ করে দুই দিন পর শর্ত মানায় তারা ছাড়া পান। এ ঘটনার পর ১৯ জুলাই নয়াপাড়া রেজিস্ট্রার ক্যাম্পের মো. ওয়ারেস (৩০) নাফ নদীতে মাছ ধরতে গেলে নবী হোসেন গ্রুপ তাকে গুলি করে হত্যা করে। এর আগে হোয়াইক্যং বালুখালি গ্রামের মো. ইলিয়াস নামের আরেক জেলে নবী গ্রুপের সদস্যদের হামলার শিকার হয়ে মারা গেছেন বলেও জানা গেছে।
হোয়াইক্যংয়ের বাসিন্দা সাইফুল নামের এক জেলে জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী গ্রুপের অত্যাচর ও নির্যাতনের ভয়ে নাফনদীসহ সীমান্তে থাকা চিংড়ি ঘেরে মাছ ধরা কঠিন। বার্মিজ বর্ণমালায় লেখা মাসিক ৮ হাজার টাকার টোকেনটি না থাকলে নাফনদ ও চিংড়ি ঘেরে যাওয়া অসাধ্য।
নাম প্রকাশে অপারগ আরও কয়েক জেলে জানান, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ স্থানীয় মিলিয়ে গড়া সিন্ডিকেটের সদস্যরা জেলেদের টোকেন সরবরাহ করেন। সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সংসারের কথা চিন্তা করে নাফনদী ও চিংড়ি ঘেরে মাছ ধরতে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু মাছ ধরতে গেলে নবী গ্রুপকে মাসিক চক্তিমতো ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা দিতে হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে যেকোনো সময় অপহরণের কবলে পড়ে।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী জানান, এলাকার অনেক জেলেরা জানিয়েছেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন গ্রুপের অত্যাচার ও নির্যাতনে তারা নাফনদী ও সীমান্তবর্তী এলাকার চিংড়ি ঘেরে মাছ ধরতে যেতে পারেন না। গেলে নবী গ্রুপকে চাঁদা দিতে হয়। না দিলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে গ্রুপটি।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জোবাইর সৈয়দ জানান, মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের প্রধান রোহিঙ্গা নবী হোসেনের বিরুদ্ধে অপহরণ, ডাকাতি ও মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে। গ্রুপের সদস্যসহ তাকে গ্রেফতারে গোয়েন্দারা কাজ করছেন।
তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিজিবি কক্সবাজার-৩৪ ব্যাটালিয়নের পক্ষ থেকে নবী হোসেনকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। উখিয়া-টেকনাফসহ বান্দরবান এলাকায় করা পোস্টারিংয়ে লেখা ছিল ‘শীর্ষ ইয়াবা গডফাদার মিয়ানমারের নাগরিক নবী হোসেন গ্রুপের প্রধান নবীকে জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে’।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন ক্যাম্পসহ নাফনদীর ওপারে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করেন বলে জেনেছি। তার দেওয়া টোকেন ছাড়া জেলেরা নাফনদী ও চিংড়ি ঘেরে মাছ ধরতে যেতে পারে না। নবী হোসেন দিনের পর দিন ক্যাম্পসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় মাদক-সন্ত্রাস ও অপহরণ বাণিজ্য চালিয়েও অধরা।
নবী হোসেনের বিষয়ে টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (২ বিজিবি) বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, নবী হোসেনকে ধরতে বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। তাকে আটক করতে পারলে ১০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা আছে। গোয়েন্দা তথ্য মতে, তিনি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে থাকায় তাকে আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। সুত্র: জাগো নিউজ
পাঠকের মতামত